{এই নাটকের চরিত্র এবং ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।}
(সেক্রেটারিয়েটের প্রবীণ আমলা কমলেশ চাকীর ঘর। কমলেশ চাকী একটা ফাইল দেখছেন। সামনে বিশিষ্ট কবি প্রবুদ্ধ কর বসে আছেন।)
কমলেশ।। আপনি ২০১১ সালে একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন –
প্রবুদ্ধ।। না। আমি একাডেমী পাই নি, আমি –
কমলেশ।। একাডেমী পাননি? সেকি, এখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে –
প্রবুদ্ধ।। ভুল লেখা আছে। ২০১১ সালে আমি –
কমলেশ।। ভুল? কি বলছেন আপনি? মন্ত্রী মশাইয়ের ডাইরেক্ট নির্দেশে এই ফাইল আমাদের স্পেশাল ব্রাঞ্চ তৈরি করেছে। এখানে ভুল থাকতে পারে না।
প্রবুদ্ধ।। আপনি কিন্তু এখনও বললেন না আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছেন।
কমলেশ।। সেটা উনিই আপনাকে বলবেন। তবে যাই বলুন না কেন, তর্ক করতে যাবেন না। আমি জানি আপনি বিরোধী দলের কার্ড ক্যারিং মেম্বার। কিন্তু এটা সংসদ নয়, এখানে কোন তর্ক উনি বরদাস্ত করবেন না। সুতরাং সামলে কথা বলবেন। রেগে গেলে উনি কিন্তু কাউকে কেয়ার করেন না। (আবার ফাইলে চোখ) আপনি শিওর ২০১১ সালে আপনি…? না না, ব্যাপারটা কনফার্ম করতে হবে। দাঁড়ান আমি স্পেশাল ব্রাঞ্চের মিস্টার মিত্তিরকে একটা ফোন –
(ফোন তুলতে যান, ঠিক সেই সময়ে মন্ত্রী মশাই প্রবেশ করেন। ফোন ছেড়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে ওঠেন কমলেশ।)
কমলেশ।। স্যার আপনি কেন কষ্ট করে – আমাকে বললে আমি ওনাকে আপনার ঘরে –
মন্ত্রী।। এখানেই ভাল। আমার ঘরে অনেক ডিস্টারবেন্স। প্রবুদ্ধ বাবু নমস্কার। (কমলেশের চেয়ারে বসতে বসতে) আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ফ্যান। আপনার সব বই আমি পড়েছি। অনেক কবিতা আমার মুখস্ত।
প্রবুদ্ধ।। ধন্যবাদ। কিন্তু আমি ঠিক এখনও –
মন্ত্রী।। বুঝতে পারছেন না কেন আপনাকে ডেকেছি, তাইতো? বলছি। কমলেশ, ওনাকে চা কফি খাইয়েছ?
কমলেশ।। না মানে উনি –
মন্ত্রী।। ছি ছি ছি। ওনার মত একজন একজন বিশিষ্ট কবি আমাদের অতিথি আর তাকে তুমি এক কাপ চা খাওয়াতে পারনি? তুমি না পাবলিক সারভেন্ট? যাও, দুকাপ চা – না চা নয়, কফি। ভাল করে দুকাপ কফি করে আন। ভাল করে, বুঝলে?
কমলেশ।। ইয়েস স্যার। (কমলেশ বেরিয়ে যায়)
মন্ত্রী।। এবার কাজের কথায় আসি। শুনুন প্রবুদ্ধ বাবু, আমি সোজা কথার মানুষ। চাঁছা ছোলা কথা বলে ফেলার জন্য আমার যথেষ্ট দুর্নাম আছে। রাজনীতি করি বটে কিন্তু আর পাঁচটা রাজনীতিবিদের মত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা আমি বলতে পারি না। এন্ড দ্যাট ইজ মাই উইকনেস। আমি চাই আপনি আমাকে মেন্টর করুন।
প্রবুদ্ধ।। (প্রায় বিষম খেয়ে) মেন্টর করব? আমি? আপনাকে?
মন্ত্রী।। হ্যাঁ। অসুবিধেটা কোথায়?
প্রবুদ্ধ।। না, মানে আমি তো ঠিক সরাসরি রাজনীতি করিনা। আর তাছাড়া –
মন্ত্রী।। প্রবুদ্ধ বাবু, রাজনীতির প্রথম শর্ত হল মানুষের মন জয় করা। আর সে কাজ আপনার মত কবির চেয়ে ভাল কে করতে পারে বলুন? একেকটা শব্দ, একেকটা পঙক্তি, একেকটা স্তবক দিয়ে আপনি যেভাবে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে যান, যেভাবে তাদের হিপ্নটাইজ করে ফেলেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেন, সেই ক্ষমতা কজন রাজনীতিবিদের আছে? আপনি আমাকে সেই আর্টটা শিখিয়ে দিন।
প্রবুদ্ধ।। আপনি কবিতা লিখতে চান?
মন্ত্রী।। একদম না। লেখা লেখি আমার একেবারেই পোষায় না। আমি চাই, আমি যখন বক্তৃতা দেব আমার প্রতিটা কথা যেন আপনার কবিতার মত মানুষের হৃদয়ে গেঁথে যায়। আমার বক্তৃতার ছন্দ যেন মানুষকে মাতাল করে দেয়। লোকে যেভাবে আপনার কবিতার লাইন কোট করে, ঠিক সেইভাবে তারা যেন আমার বক্তৃতার লাইন কোট করে। আপনি আমার পাশে থাকুন, আমাকে ট্রেন করুন। আমি খুব ভাল ছাত্র, আপনাকে আমি হতাশ করব না।
প্রবুদ্ধ।। আপনি যা চাইছেন তার জন্য একজন ভাল স্পিচ রাইটারই তো যথেষ্ট। অনেকেই আছেন –
মন্ত্রী।। স্পিচ নয়, স্পিচ নয় প্রবুদ্ধ বাবু – কবিতা। ছন্দ, শব্দ, চিত্রকল্প – আপনাকে আমি বোঝাতে পারছি? মঞ্চে মাইকের সামনে আর গলাবাজি করতে চাই না আমি। ওসব পুরনো হয়ে গেছে। এখন কেবল কবিতা – আমার কণ্ঠ থেকে সোচ্চার, স্বতঃস্ফূর্ত, উদ্দিপনাময় কবিতা ছড়িয়ে পড়বে ব্রিগেডের জনারণ্যে! মানুষ পাগল হয়ে যাবে। উফ! ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে!
প্রবুদ্ধ।। কিন্তু আমি কি করে আপনাকে শেখাব? আমাদের আইডিওলজি –
মন্ত্রী।। এক এবং অভিন্ন। প্রবুদ্ধ বাবু, আমরা সবাই চাই বাংলার মানুষকে কিছু দিতে, তাদের সুখী করতে। কিছুই তো তাদের দিতে পারিনি। আপনার দল পারে নি, আমরাও পারিনি। এবার নাহয় কিছু দিলাম। আপনি আমি দুজনেই জানি, কবিতা পেলে বাংলার মানুষ আর কিছু চায় না। শিল্প, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ল-এন্ড-অরডার এসব না হলেও তাদের চলে যাবে। কিন্তু কবিতা ছাড়া বাঙ্গালির এক মুহূর্ত চলবে না। এটুকু যদি ওঁদের দিতে পারি, তাহলেই ওঁরা খুশি। আর কিচ্ছু চাই না।
(দরজা খুলে যায়, কফির ট্রে হাতে কমলেশ ঢোকেন।)
কমলেশ।। কফি?
মন্ত্রী।। হ্যাঁ কফি অবশ্যই চাই। এখানে রাখ। আর হ্যাঁ, কমলেশ শোন। প্রবুদ্ধ বাবুর ফাইলে একটা টাইপো-গ্রাফিকাল এরার রয়েছে। একাডেমী উনি ২০১১ তে পান নি, এবছর পাবেন। ওটা শুধরে দিও। (কফির কাপ এগিয়ে দেন) প্রবুদ্ধ বাবু তাহলে ওই কথাই রইল? কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেস এসে পড়বে। সুসংবাদটা নিজের মুখেই ওদের জানিয়ে দেবেন।
প্রবুদ্ধ।। (উঠে দাঁড়ান) আমি দুঃখিত মন্ত্রী মশাই। আমি আপনার কোন কাজে আসব না। আমি কবিতা লেখা, কবিতা চর্চা চিরদিনের মত ছেড়ে দিয়েছি।
মন্ত্রী।। সে কি? কবে ছাড়লেন?
প্রবুদ্ধ।। এই তিরিশ সেকেন্ড আগে। এখন আমি কেবল একজন সাধারণ নাগরিক যার অনেক কিছু চাহিদা অপূর্ণ রয়ে গেছে। সেগুলি আদায় করা এখন আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি চলি। নমস্কার।
(প্রবুদ্ধ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান, মন্ত্রী হাঁ করে সে দিকে চেয়ে থাকেন। আলো নিভে যায়।)
সমাপ্ত